আল্লাহ্র সুন্দর নাম ও সিফাতসমূহের উপর বিশ্বাস স্থাপন
অর্থাৎ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর নিজের জন্য তাঁর কিতাবে বা তাঁর রাসূলের সুন্নতে যে সমস্ত উপযুক্ত সুন্দর নাম ও সিফাত সাব্যস্ত করেছেন সেগুলোকে কোন ধরনের তাহরীফ (تحريف-গুণকে বিকৃত করা), তা’তীল (تعطيل-গুণকে অস্বীকার করা), তাকয়ীফ (تكييف-গুণ বা বৈশিষ্ট্যের অবয়ব নির্ধারণ করা) বা তামসীল (تمثيل-মাখলুকের গুণের সাথে সাদৃশ্য দেয়া) ছাড়া নিঃসঙ্কোচে মেনে নেয়া।
আল্লাহ্ বলেন, “আর আল্লাহ্র সুন্দর সুন্দর ভালো নাম রয়েছে। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকবে। আর তাদেরকে বর্জন করো, যারা তাঁর নাম বিকৃত করে। অচিরেই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেয়া হবে।”[সূরা আ’রাফ, ৭:১৮০] আল্লাহ্র জন্য সুনির্দিষ্ট সুন্দর নাম সাব্যস্ত থাকার ব্যাপারে এ আয়াতটি সুস্পষ্ট দলীল।
আল্লাহ্ বলেন, “আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ গুণ তাঁরই এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”[সূরা রুম, ৩০:২৭] এ আয়াতটি আল্লাহ্র পরিপূর্ণ সিফাতসমূহ সাব্যস্ত হওয়ার প্রমাণ। কেননা, আয়াতে বর্ণিত الْمَثَلُ الأَعْلَى অর্থ হলো الوصف الأكمل তথা পরিপূর্ণ গুণ। এ আয়াতদুটো আল্লাহ্র নাম ও সিফাতের বিষয়টি আমভাবে সাব্যস্ত করে। পাশাপাশি এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা কোরানে ও হাদিসে প্রচুর বিদ্যমান।
আল্লাহ্র নাম ও সিফাতের
“আল্লাহ্র নাম ও সিফাতের” অধ্যায়টি জ্ঞানের এমন একটি শাখা যে বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ চরম মতপার্থক্যে লিপ্ত হয়েছে। এ মতপার্থক্যগুলোর সূত্র ধরে তারা নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে। এই মতভেদপূর্ণ পিচ্ছিল পটভূমিকায় আমাদের অবস্থান হলো আল্লাহ্র নির্দেশিত “নিরাপদ অবস্থান।” তিনি বলেন,
“যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে কোন মতবিরোধ হয়, তবে আল্লাহ্ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তিত হও, যদি তোমরা আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাস করে থাকো। এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর পরিসমাপ্তি।”[সূরা নিসা : ৫৯] সুতরাং, আমরা এ বিষয়ে যাবতীয় মতপার্থক্যকে আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নতের দিকে ফিরাই।
পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে আমাদের সৎকর্মশীল পূর্বসূরি সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের মতামতগুলো পর্যালোচনাপূর্বক গ্রহণ করি। কারণ তাঁরা ছিলেন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের কথার তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তি।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) সাহাবীদের প্রশংসা করতে গিয়ে কত সুন্দর করেই না বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোন পথ অনুসরণ করতে চায়, তবে সে যেন যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের পথ অনুসরণ করে। কারণ, জীবিতরা ফেতনার আশংকা থেকে নিরাপদ নয়। আর সে সব মৃতরা হলেন রাসূলের সঙ্গী-সাথীরা। তাঁরা এ উম্মতের মাঝে হৃদয়ের দিক থেকে সবচেয়ে স্বচ্ছ ও পবিত্র, জ্ঞানের দিক থেকে সবচেয়ে গভীর, আর কৃত্রিম আচরণের দিক থেকে সবচেয়ে স্বল্প। তাঁরা এমন একদল লোক, যাঁদেরকে আল্লাহ্ তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তাঁর রাসূলের সাহচর্যের জন্য মনোনীত করেছেন। সুতরাং তাঁদেরকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করো। তাঁদের অনুসৃত পথ আঁকড়ে ধরো। কারণ তাঁরা ছিলেন সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত।”
যে কেউ এ অধ্যায়ে (আল্লাহ্র নাম ও সিফাত) সাহাবী ও তাবেয়ীদের দেখানো পথ থেকে সরে গিয়েছে, সেই ভুল করেছে। পথভ্রষ্ট হয়েছে। মুমিনদের রাস্তা থেকে ছিটকে পড়েছে। এবং আল্লাহ্র সেই ঘোষিত শাস্তির উপযুক্ত হয়েছে যাতে তিনি বলেন, “হেদায়েতের পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও যে ব্যক্তি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছেড়ে অন্য পথের অনুগামী হয়, তবে সে যাতে নিবিষ্ট আছে আমি তাকে তাতেই প্রত্যাবর্তিত করবো এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর সেটা কতইনা নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল।”[সূরা নিসা ৪:১১৫]
আল্লাহ্ তায়ালা হেদায়েতের জন্য শর্ত করে দিয়েছেন যে, ঈমান হতে হবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সঙ্গীদের ঈমানের মত। ইরশাদ হচ্ছে- “অনন্তর তোমরা যেরূপ বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তারাও যদি তদ্রূপ বিশ্বাস স্থাপন করে তবে নিশ্চয়ই তারা সুপথ প্রাপ্ত হবে।”[সূরা বাকারাহ ২:১৩৭] বুঝা গেল তাদের অনুসৃত পথ থেকে যে ব্যক্তি যত বেশী দূরে সরে যাবে, তার হেদায়েত প্রাপ্তির পরিমাণও সে হারে কমে আসবে। সুতরাং আল্লাহ্র নাম ও সিফাতের এ অধ্যায়ে আমাদের জন্য আবশ্যক হলো-
- আমরা আল্লাহ্র জন্য কেবলমাত্র সে সব নাম ও সিফাত সাব্যস্ত করব, যা তিনি অথবা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাব্যস্ত করেছেন।
- এ সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিসসমূহকে এর প্রকাশ্য অর্থের উপরে রাখব; রূপকার্থ খুঁজতে যাবো না।
- রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীরা এগুলোর ক্ষেত্রে যে রূপ বিশ্বাস রাখতেন, আমরাও তাই রাখব। কারণ তাঁরা ছিলেন উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী।
পাশাপাশি আমাদেরকে জেনে রাখতে হবে যে, এখানে চারটি বিষয় রয়েছে, যেগুলো বিপদসংকুল খাদের মত। যে ব্যক্তি এগুলোর কোনটায় পড়বে, আল্লাহ্র নাম ও সিফাতের ব্যাপারে তার ঈমান যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হবে না। এক্ষেত্রে ঈমানকে সঠিক মাত্রায় ধরে রাখতে হলে এ চারটি বিষয় থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে। সেগুলো হল- তাহরীফ (গুণকে বিকৃত করা) , তা’তীল (গুণকে অস্বীকার করা), তামসীল (মাখলুকের গুণের সাথে সাদৃশ্য দেয়া) ও তাকয়ীফ (গুণ বা বৈশিষ্ট্যের অবয়ব নির্ধারণ করা)।
(১) তাহরীফ (تحريف)
আল্লাহ্র নাম ও সিফাত সংক্রান্ত কোরান বা হাদিসের নস্সমূহকে (স্পষ্ট দলীলসমূহকে) এর সঠিক অর্থ থেকে পরিবর্তন করে অন্য দিকে সরিয়ে নেয়া, কিংবা অন্য অর্থ করা, যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল উদ্দেশ্য করেননি। যেমন- (يد الله) তথা আল্লাহ্র হাত। আল্লাহ্র হাত থাকার সিফাতটি কোরান ও হাদিসের অনেক নস্ দ্বারাই প্রমাণিত। এখানে “হাত” কে নেয়ামত বা কুদরত অর্থে গ্রহণ করা তাহরীফ।
(২) তা’তীল (تعطيل)
আল্লাহর সকল নাম ও সিফাতকে অস্বীকার করা কিংবা এর কোন কোনটিকে অস্বীকার করাকে “তাতীল” বলে। সুতরাং কেউ যদি কোরান ও হাদিসে বর্ণিত আল্লাহ্র নাম ও সিফাতসমূহের কোন একটিকেও মানতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলেই সে তার ঈমানকে যথার্থভাবে বাস্তবায়নে সক্ষম হলো না।
(৩) তামসীল (تمثيل)
আল্লাহ্র কোন সিফাত বা বিশেষণকে সৃষ্টির সিফাতের সাথে সাদৃশ্য প্রদান করাকে “তামসীল” বলে। যেমন কেউ যদি বলে- ‘আল্লাহ্র হাত মানুষের হাতের মত বা মাখলুক যেভাবে শুনে আল্লাহ্ও সেভাবে শোনেন কিংবা আল্লাহ্ আরশের উপরে সেভাবেই বসে আছেন যেভাবে মানুষ চেয়ারে বসে…’
সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যের সাথে স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যকে তুলনা করা নিঃসন্দেহে বাতিল। আল্লাহ্ বলেছেন, “কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”[সূরা শুরা: ১১]
(৪) তাকয়ীফ (تكييف)
আল্লাহ্র সিফাত তথা বৈশিষ্ট্যসমূহের আকৃতি-প্রকৃতি ও হাকীকত নির্ধারণ করাকে “তাকয়ীফ” বলে। অর্থাৎ মানুষ তার কল্পনার দৌড় অনুযায়ী বা ভাষার চতুরতার আশ্রয় নিয়ে আল্লাহ্র গুণাবলীর ধরণ নির্ধারণ করা। এটা অকাট্যভাবে নিষিদ্ধ ও বাতিল। মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় আল্লাহ্র সিফাতের বৈশিষ্ট্য জানা। আল্লাহ বলেন, “তারা জ্ঞান দিয়ে তাঁকে আয়ত্ত করতে পারব না।”[সূরা ত্বহা: ১১০]
‘ঈমান বিল্লাহ্’ এর এ চারটি দিক যে ব্যক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সে ব্যক্তি আল্লাহ্র প্রতি যথাযথভাবে ঈমান এনেছে।
মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে ঈমানের উপর অবিচল রাখুন। আর তিনিই সর্বজ্ঞ।
দেখুন: শায়খ উছাইমিন রচিত “শারহুল উছুলিল ঈমান”।
সূত্র
ইসলাম কিউ এ ইনফো, শাইখ উছাইমিন রহঃ