কারাগারে ইমাম তাইমিয়ার তৎপরতা
সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকে যার নিজেদের জীবনের লক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে, তার দুনিয়ার কোন বাধাকে বাধা বলেই মনে করে না।
অণুকুল ও প্রতিকুল যে কোন পরিবেশেই তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকে।
একটা অণুকুল পরিবেশের আশায় তারা নিজেদের কাজ ও প্রোগ্রাম স্থগিত রেখে চুপচাপ বসে থাকেনা।
কোন কারাপ্রাচীর এ ধরনের মর্দে মুজাহিদদের কর্মস্পৃহাকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনা।
একদিকের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তারা অন্যদিকের কাজের দরজা খুলে দেন।
কারেগারে ইমাম যা করেছেন
দামেস্কের কারাগারে ইমাম ইবনে তাইমিয়াও সেই একই পথ অবলম্বন করলেন।
বাইরে তিনি জ্ঞানের প্রসার, সংস্কার ও চরিত্র গঠনের যে দায়িত্ব পালন করছিলেন কারাগারে আটক থাকার কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলো ঠিকই কিন্তু এতে তিনি মোটেই দমলেন না।
কারাগারে একদিকে তিনি নিজের ইবাদত বন্দেগী ও কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে গেলেন এবং অন্যদিকে ব্যক্তিগত অধ্যয়নও গ্রন্থ রচনায় মন দিলেন বেশি করে।
বিশেষ করে নিজের আগের লেখা বইগুলোর সংস্কার ও সম্পাদনায় ব্রতী হলেন।
এ সময় তিনি কুরআন গবেষণায় ও কুরআনের জটিল গ্রন্থগুলো উন্মোচনের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
সম্ভবত জ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি যে পরিপক্বতায় এসে পৌঁছেছিলেন তার সাথে কারাগারের নিরুপদ্রব পরিবেশ এবং নিবিষ্ট চিত্তে কুরআন অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ তাঁকে এ কাজে পারদর্শী করে তুলেছিল।
আস্তে আস্তে জেলের পরিবেশ তাঁর কাছে সহনীয় ও স্বাভাবিক হয়ে উঠলো।
এখানে বসে বসে তিনি যা কিছু লিখতেন কিছুক্ষণের মধ্যে কারাগারের বাইরে তা ছড়িয়ে পড়তো।
সারাদেশেও তা ছড়িয়ে পড়তো মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে।
জেলের বাইরে থেকে লোকেরা তাঁর কাছে ফতোয়া জানতে চেয়ে চিঠি লিখে পাঠাতো। জেলের মধ্যে বসে তিনি তার জবাব লিখে বাইরে পাঠিয়ে দিতে।
কাজেই এ অবস্থায় জেলের ভেতর ও বাইর তাঁর জন্যে সমা হয়ে দাঁড়াল।
বরং জেলের মধ্যে বসে তিনি নিশ্চিন্তে নিজের মত প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন।
এসময় তিনি মিসরের মালেকী মযহাবের কাযি আবদুল্লাহ ইবনুল আখনায়ীর একটি মতের কঠোর সমালোচনা করলেন।
এ সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি কাযী সাহেবের শরীয়ত ও ফিকহের জ্ঞানের অপ্রতুলতা সম্পর্কেও মন্তব্য করলেন।
এ মন্তব্যে কাযী সাহেবের ক্রোধকে উদ্দীপিত করলো।
তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।
সুলতানের দরবারে নালিশ করলেন এবং ইমামের বিরুদ্ধে আক্রোশ প্রকাশ করে নিজের মনের ঝাল মেটালেন।
বই কলম ছিনিয়ে নেয়া হলো
সুলতান ফরমান জারি করলেনঃ ইমামের কাছে কাগজ কলম, দোয়াত ইত্যাদি যা কিছু লেখার সরঞ্জাম আছে ছিনিয়ে নেয়া হোক।
বইপত্রও সব সরিয়ে নেওয়া হোক।
তিনি যেন আর লেখাপড়া করতে না পারেন। তাঁর মতামত যেন আর কোনক্রমেই জনসমক্ষে প্রচারিত হতে না পারে।
একজন লেখক, সমালোচক ও সমাজ সংস্কারকের জন্য বোধহয় এর চেয়ে বড় আর কোন শাস্তি নেই।
হয়তো মৃত্যুদণ্ড তাঁর কাছে এর চেয়ে শতগুণ সহজ।
৭২৮হিজরীর ৯ জমাদিউস সানী সরকারী ফরমান অনুযায়ী তাঁর সব কাগজপত্র ও লেখার সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে নেয়া হলো।
এগুলো আদালতের লাইব্রেরীতে দাখিল করে দেয়া হলো। এখানে তাঁর প্রায় ৬০খানা গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ছিল।
সরকারের এ দমননীতিতে ইমাম একটুও দমলেন না।
তিনি সরকারের কাছে কোন অনুযোগ অভিযোগও করলেন না।
নীরবে সব সহ্য করে গেলেন। দোয়াত, কলম, খাতাপত্র ও কাগজ কেড়ে নেবার পর তিনি বিচ্ছিন্ন ও টুকরো কাগজ কুড়িয়ে জমা করলেন।
সেগুলোর ওপর কয়লা দিয়ে লিখতে লাগলেন। পরবর্তীকালে এভাবে লিখিত তাঁর কয়েকটি পুস্তিকা পাওয়া গেছে।
এগুলো বহুকাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত অবস্থায় ছিল। জীবনের এ অবস্থায়ও তিনি জিহাদের লিপ্ত রয়েছেন বলে মনে করতেন।
মিসরীয় লেখক শায়খ আবু যোগরা তাঁর ইবনে তাইমিয়া গ্রন্থ ইমামের এ সময়কার লিখিত একটি পত্র উদ্ধৃত করেছেন।
এ পত্রে তিনি বলেছেনঃ
আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর পথে অনেক বড় জিহাদে লিপ্ত রয়েছি।
এখানকার জিহাদ তাতারী সম্রাট কাযানের বিরুদ্ধে জিহাদ বা জাহামীয়া ও সর্বেশ্বরবাদীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আমাদের অতীতের জিহাদগুলোর চাইতে কোন অংশে কম নয়।
এটা আমাদের ও জনগণের ওপর আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ।
কিন্তু অধিকাংশ লোক এর তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম।
পরকালের পথে যাত্রা
ইমামের সময়ও শেষ হয়ে এসেছিল। মৃত্যু শয্যায় দামেস্কের গভর্নর তাঁকে দেখতে এলেন। গভর্নর শোকাভিভূত কণ্ঠে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
জবাবে ইমাম বললেনঃ
আপনার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। আপনাকে আমি মাফ করে দিয়েছি। আমি তাদেরকেও মাফ করে দিয়েছি যারা আমার সাথে শত্রুতা করেছে।
আমার বক্তব্যের ও কর্মকাণ্ডের সত্যতা সম্পর্কে তাদের মনে কোন প্রকার সন্দেহ ছিল না এবং এখানো নেই।
আমি সুলতানকেও মাফ করে দিয়েছি। কারণ সুলতান স্বেচ্ছায় নয় বরং উলামায়ে কেরামের ফতোয়ার কারণে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন।
আমি সবাইকে এ ব্যাপারে ক্ষমা করে দিয়েছি।
তবে সেই ব্যক্তিকে আমি কোনদিনই ক্ষমা করতে পারিনা, যে আল্লাহ ও তার রসুলের শত্রু এবং আল্লাহ ও তঁর রসুলের প্রতি আক্রোশের বশবর্তী হয়ে আমার বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে এবং আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে।
৭২৮ হিজরির ২২ জিলকদ ৬৭ বছর বয়সে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিন।
দুর্গের মুয়াজ্জিন মসজিদের মিনারে উঠে তাঁর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন।
দুর্গের চারদিকের উঁচু বুরুজগুলো থেকে সমস্বরে এ ঘোষণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
সংগে সংগে শহরের মসজিদগুলো থেকে শোক বর্তা ইথারে ইথারে চতুর্দিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
মুহূর্তে শহরের সমস্ত আনন্দ কোলাহল স্তব্ধ হয়ে যায়।
শোকের ছায়া নেমে আসে অলিতে গলিতে, রাজপথে, অলিন্দে, গৃহকোণে, মানুষের মুখে চোখে।
দুর্গের পথে ঢল নামে শোকাহত মানুষের। শত্রুরাও শত্রুতা ভুলে যায়। তারাও মূর্ছিত, বেদনাহত।
দুর্গের সদর দরজা খুলে দেয়া হয়। লোকেরা দলে দলে যেতে থাকে ইমামের মরদেহ এক নজর দেখে হৃদয়ের শোকাবেগকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও প্রশমিত করতে।
গোসলের পর তাঁর জানাজা শহরের বৃহত্তম মসজিদ জামে উমুবীতে আনা হয়।
দুর্গ ও জামে উমুবীর মধ্যকার দীর্ঘ রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়।
ভিড় থেকে জানাজাকে রক্ষা করার জন্য সেনাবাহিনীর লোকদের ব্যবস্থাপনায় লাশ জামে মসজিদে আনা হয়।
তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ লিছ জামে উমুবী।
এ মসজিদ ভরে গিয়ে সামনে ময়দান, রাজপথ, আশপাশের অলি গলি, বাজার সব লোকে ভরে যায়।
ঐতিহাসিকদের মতে ইতিপূর্বে ইসলামী বিশ্বের আর কোথাও এত বড় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়নি।
এদিন শহরের দোকান পাট সব বন্ধ থাকে। বহু লোক রোজা রাখে এবং বহু লোক খাবার কথা ভুলে যায়।
জানাজা গোরস্তানের দিকে নিয়ে যাবার সময়ও লোকের ভিড়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে।
ফজরের পর দুর্গ থেকে জানাজা বের করা হয়।
যোহরের পর জানাজার নামায অনুষ্ঠিত হয় এবং জনতার ভিড় ঠেলে নিকটবর্তী গোরস্তানে পৌছতে আসরের ওয়াক্ত হয়ে পড়ে।
অতি অল্প সময়ে ইমামের মৃত্যু সংবাদ সারা ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।